ফুলকপি চাষের পদ্ধতি
ফুলকপি চাষের পদ্ধতি
![]() |
| ফুলকপি |
ফুলকপি শীতের প্রধান জনপ্রিয় সবজি। শীতের সবজি হলেও ফুলকপি এখন গ্রীষ্মকালেও চাষ হচ্ছে। চলুন জেনে নেই কিভাবে ফুলকপি চাষ করবেন-
➤ফুলকপি চাষে জলবায়ু ও মাটিঃ
ফুলকপি চাষের জন্য উর্বর দোঁআশ ও এটেল মাটি সবচেয়ে ভালো। উঁচু জমি যেখানে পানি জমে না এবং সারা দিন রোদ পায় এরূপ জায়গা ফুলকপি চাষের জন্য উত্তম। ফুলকপি চাষের মাটিতে যত জৈব পদার্থ থাকবে ফলন ততই ভালো হবে। মাটির অম্লমান বা পিএইচ ৬.০-৬.৫ ফুলকপি চাষের জন্য উত্তম। ফুলকপির জন্য ঠাণ্ডা ও আর্দ্র জলবায়ু ভালো।
➤ফুলকপির বীজ_বপনের সময়ঃ
ফুলকপি বপনের উপযুক্ত সময় হল আগষ্ট ও সেপ্টেম্বর। প্রতি শতকে বীজের পরিমাণ দুই গ্রাম।
➤ফুলকপির জাত_পরিচিতিঃ
শীতকালেই আগাম, মধ্যম ও নাবী মৌসুমে বিভিন্ন জাতের ফুলকপি আবাদ করা যায়। এ ছাড়া গ্রীষ্মকালে চাষের উপযোগী জাতও আছে। আমাদের দেশে মাঘী, অগ্রহায়ণী, পৌষালী, বারি ফুলকপি-১, ২ ইত্যাদি বিভিন্ন জাতের ফুলকপি পাওয়া যায়।
➤ফুলকপির আগাম জাতঃ
কার্তিকা, পাটনাই, আগাম স্নোবল, ট্রপিক্যাল, বসন্ত, অগ্রহায়ণী, বারি ফুলকপি-২, কেএস-৬০, সুপ্রীম সীডের সামার ডায়মন্ড, ব্র্যাক-৮০, লালতীরের তাব্বি এফ - ১, নামধারী মালিক সীডের আর্লী এ্যাটার্কশন, আর্লী হোয়াইট ইত্যাদি। এসব জাতের বীজ শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে বুনতে হয়।
➤ফুলকপির মাঝারি জাতঃ
পৌষালী, স্নোবল ওয়াই, স্নোবল-১৬, হোয়াইট বিউটি, লালতীরের সিভান এফ-১, সুপ্রীম সীড কোম্পানীর স্নো ডায়মন্ড এবং বারি ফুলকপি-১ (রূপা) ইত্যাদি। এসব জাতের বীজ ভাদ্র-আশ্বিন মাসে বপন করতে হয়।
➤ফুলকপির নাবি জাতঃ
হোয়াইট মাউন্টেন, ইউনিক স্নোবল, মাঘী, রাক্ষুসী ইত্যাদি। এসব জাতের বীজ আশ্বিন-কার্তিক মাসে বপন করতে হয়।
➤ফুলকপির জাতের_বৈশিষ্ট্যঃ
বারি ফুলকপি-১ (রূপা): এটি মাঝারী আগাম জাত। প্রতিটি ফুলকপির গড় ওজন ৮৫০-১০০০ গ্রাম। এজাতটি বীজ বপনের ৯৫-১০৫ দিনের মধ্যে কপি খাওয়ার উপযুক্ত হয়।
➤বারি ফুলকপি-২ঃ
মাঝারী আগাম জাত। প্রতিটি ফুলকপির গড় ওজন ৭০৫-৮০০ গ্রাম। এ জাতটি বীজ বপনের ৮৫ দিনের মধ্যে কপি খাওয়ার উপযুক্ত হয়।
➤কে এস-৬০ঃ
আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাস রোপণের উপযুক্ত সময়।চারা রোপণের ৬০ দিন পর ফুলকপি সংগ্রহ করা যায়। । জাতটি কালো পচা ও গোড়া পচা রোগ সহনশীল।প্রতিটি কপির গড় ওজন ৮০০-৯০০ গ্রাম।
➤ব্র্যাক-৮০ঃ
আগষ্ট -সেপ্টেম্বর মাস রোপণের উপযুক্ত সময়। চারা রোপণের ৬০-৬৫ দিন পর ফুলকপি সংগ্রহ করা যায়।
➤ফুলকপির প্রথম_বীজতলাঃ
ফুলকপির চারা বীজতলায় উৎপাদন করে জমিতে লাগানো হয়। বীজতলার আকার ১ মিটার পাশে ও লম্বায় ৩ মিটার হওয়া উচিত। সমপরিমাণ বালি, মাটি ও জৈবসার মিশিয়ে ঝুরাঝুরা করতে হয়।
বীজতলার উপরের স্তরে ১:১ অনুপাতে পচা গোবর/আবর্জনা সার এবং দো-আঁশ মাটির মিশ্রণ ছড়িয়ে দিতে হবে। এরপর তিন-চার সপ্তাহ পলিথিন দিয়ে মাটি ঢেকে রেখে শোধনের পর পাঁচ সে. মি. দূরে দূরে লাইনে ছিটিয়ে ১০ গ্রাম বীজ বুনতে হবে। অতিবৃষ্টি ও রোদের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য উপরে পলিথিন বা চাটাইয়ের আচ্ছাদন দিতে হবে।
➤ফুলকপির ২য়_বীজতলায় চারা_রোপণঃ
বীজ গজানোর ১০-১২ দিন পর গজানো চারা দ্বিতীয় বীজতলায় স্থানান্তর করতে হয়। দ্বিতীয় বীজতলায় চারা রোপণের আগে ৭/৮ দিন পূর্বে প্রতি বীজতলায় ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পরে চারা ঠিকমত না বাড়লে প্রতি বীজতলায় প্রায় ১০০ গ্রাম পরিমাণ ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিলে ভালো হয়।
➤ফুলকপির চারা মূল জমিতে রোপণঃ
চারায় ৫-৬টি পাতা হলেই তা রোপণের উপযুক্ত হয়। সাধারণত ৩০-৩৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করা হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০ সেন্টিমিটার বা ২ ফুট এবং প্রতি সারিতে চারা থেকে চারার দূরত্ব দিতে হবে ৪৫ সেন্টিমিটার বা দেড় ফুট। চারা রোপণের সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন শিকড় মুচড়ে বা বেঁকে না যায়। এতে চারার বৃদ্ধি কমে যায়।
➤জমি_তৈরি ও সার প্রয়োগঃ
জমি তৈরির সময় অর্ধেক গোবর সার, পুরো TSP, অর্ধেক MOP এবং বোরন সার প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক গোবর সার চারা রোপণের ১ সপ্তাহ আগে মাদায় দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর চারা রোপণ করে সেচ দিতে হবে।ইউরিয়া এবং বাকি অর্ধেক এমওপি ও বোরন সার ৩ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।
♥প্রথম কিস্তি- চারা রোপণের ৮-১০ দিন পর,
♥দ্বিতীয় কিস্তি- চারা রোপণের ৩০ দিন পর এবং
♥শেষ কিস্তি- ৫০ দিন পর।
✪✔তবে পুরো বোরাক্স বা বোরন সার জমি তৈরির সময় দেওয়া যাবে।
➤সারের মাত্রাঃ
প্রতি শতকে সারের পরিমাণ
ইউরিয়া ১.০-১.২ কেজি
টি এস পি ০.৬-০.৮ কেজি
এমওপি ০.৮-১.০ কেজি
বোরাক্স ২৮-৪০ গ্রাম
গোবর ৬০-৮০ কেজি
➤সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনাঃ
সার দেয়ার পরপরই সেচ দিতে হবে। জমিতে পানি বেশি সময় ধরে যেন জমে না থাকে সেটাও খেয়াল করতে হবে। সার দেয়ার আগে আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে।
➤সেচ ব্যবস্থাপনাঃ
☞রোপনের পর প্রথম ৪-৫ দিন একদিন পরপরই সেচ দিতে হবে। পরবর্তীতে ৮-১০ দিন অন্তর বা প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিলেই চলবে।
☞ সেচ পরবর্তী জমিতে “জো” আসলে ফুলকপির স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য মাটি চটা ভেঙ্গে দিতে হবে এবং জমির আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
☞সারের উপরি প্রয়োগ যথা সময়ে করতে হবে। উল্লেখ্য সারের উপরি প্রয়োগের পর অবশ্যই সেচ দিতে হবে।
☞ পানি সেচ ও নিষ্কাশনের জন্য বেড সর্বদা পরিষ্কার রাখতে হবে।
➤বিশেষ পরিচর্যাঃ
ফুলকপি গাছে সার দেয়ার পর সারির মাঝখানের মাটি তুলে দুপাশ থেকে গাছের গোড়ায় টেনে দেয়া যায়। এতে সেচ ও নিকাশের সুবিধা হয়। তবে ফুলকপির ফুল সাদা রাখার জন্য কচি অবস্থায় চারদিক থেকে পাতা টেনে বেঁধে ফুল ঢেকে দিতে হবে। যদি সূর্যের আলো সরাসরি ফুলে পড়ে তবে ফুলের রঙ তথা ফুলকপির রঙ হলুদাভ হয়ে যাবে।
➤পোকামাকড় ব্যবস্থাপনাঃ
ক্ষতিকর পোকা হল মাথা খেকো লেদা পোকা। নাবী করে লাগালে সরুই পোকা বা ডায়মন্ড ব্যাক মথ বেশি ক্ষতি করে। অন্যান্য পোকার মধ্যে ক্রসোডলমিয়া লেদা পোকা, কালো ও হলুদ বিছা পোকা, ঘোড়া পোকা ইত্যাদি মাঝে মাঝে ক্ষতি করে থাকে।
➤রোগ ব্যবস্থাপনাঃ
☞ ফুলকপির পাতায় দাগ ও কালো পচা রোগ প্রধান সমস্যা। এছাড়া চারা ধ্বসা বা ড্যাম্পিং অফ, ক্লাব রুট বা গদাই মূল, মোজেইক, পাতার আগা পোড়া ইত্যাদি রোগও হয়ে থাকে।
☞বোরন সারের অভাবে ফুলে বাদামী দাগ পড়ে ও কান্ড ফাঁপা হয়ে যায়।
➤ফসল সংগ্রহঃ
মাথা আলতো ও হলদে রঙের ফুলকপির দাম কম হয়। তাই সাদা রঙ ও আঁটো সাঁটো থাকতে থাকতেই ফুলকপি তুলে ফেলা উচিত।
(তথ্য সূত্র - কৃষি বাতায়ন, bamis.gov.bd, aisekrishi.org, ajkerkrishi.com, agriculturelearning.com.e-Krishi Clinic.)
