সরিষার বিভিন্ন জাত ও চাষ পদ্ধতি
সরিষার বিভিন্ন জাত ও চাষ পদ্ধতি
![]() |
| সরিষা |
সরিষা বাংলাদেশের প্রধান ভোজ্য তেল ফসল। বিভিন্ন জাতের সরিষার বীজে প্রায় ৪০-৪৪% তেল থাকে। খৈলে প্রায় ৪০% আমিষ থাকে।
মাটি:
উর্বর ও মধ্য উর্বর দোআঁশ ও পলি দোআঁশ মাটি সরিষা চাষের জন্যে উত্তম৷ মাটির বর্ণ গাঢ় ধূসর হওয়া ভালো৷ লালমাটিতে সরিষার চাষ ভালো হয় না৷ মাটির অম্লমান ৬.০ থেকে ৭.০ এর মধ্যে থাকলে উত্তম৷ লোনা মাটিতে সরিষা ভালো হয় না৷ শুষ্ক অবস্থায় ফাটল ধরা মাটিতে সরিষা ভালো হয় না৷ উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি সরিষার জন্যে ভালো৷ আগাম পানি নিকাশ হলে মাঝারি নিচু জমিতে চাষ করা যায়। উঁচু-নিচু জমিতে সরিষার চাষ করা যায় না৷ জমি উন্মুক্ত স্থানে হওয়া দরকার, যাতে সেখানে সারাদিন রোদ পড়ে৷
জলবায়ু :
১৫-৩০ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ অধিক তাপ তেলের পরিমাণ কমিয়ে দেয়৷
বায়ুর আপেক্ষিক আর্দ্রতাঃ
৫০-৭০ডিগ্রি৷ বায়ুর আর্দ্রতা বাড়লে রোগ বিশেষত অল্টারনারিয়া পাতা ধসা ও পোকার প্রকোপ বাড়ে৷
জীববৈচিত্র্যঃ
সরিষার চাষ এলাকায় পর্যাপ্ত মৌমাছি থাকতে হবে৷ এতে সরিষার পরাগায়ন ভালো হয়৷ কীটনাশক প্রয়োগে মৌমাছি না আসায় ফসল কম হয়৷
বৃষ্টিপাতঃ
কম বা বৃষ্টিহীন পরিবেশ সরিষা উৎপাদনের জন্যে ভালো৷
অতিবৃষ্টিঃ
মৌসুমের শুরুতে নভেম্বর মাসে ও শেষে ফেব্রুয়ারি মাসে অতিবৃষ্টি সরিষার জন্য খুব ক্ষতিকর হয়ে থাকে৷
বাংলাদেশে ৩ প্রকার সরিষার চাষ বেশি হয়। এ গুলো হলো-টরি, শ্বেত ও রাই।
সরিষার জাত
টরি-৭
ফসল বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত ৭০-৮০ দিন সময় লাগে। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টর প্রতি ফলন ৯৫০-১১০০ কেজি হয়। বীজে তেলের পরিমাণ ৩৮-৪১%। জাতটি রোগবালাই সহনশীল।
সোনালী সরিষা (এসএস-৭৫)
ফলে ৪ টি কক্ষ থাকে এবং প্রতি ফলে বীজের সংখ্যা ৩৫-৪৫ টি । বীজের রং হলদে সোনালী । বীজ গোলাকার।হাজার বীজের ওজন ৩.৫-৪.৫ গ্রাম এবং বীজে তেলের পরিমাণ ৪৪-৪৫%। গাছের কান্ড ও শিকড় শক্ত বলে অধিক সার ও সেচ প্রয়োগে গাছ নুয়ে পড়ে না।
কল্যাণীয়া (টিএস-৭২)
বীজ গোলাকার। হাজার বীজের ওজন ২.৫-৩.০ গ্রাম। বীজে তেলের পরিমাণ ৪০-৪২%। ফসল পাকতে ৭৫-৮৫ দিন সময় লাগে। উন্নত পদ্দতিতে চাষ করলে প্রতি হেক্টরে ১.৪৫-১.৬৫ টন ফলন পাওয়া যায়। কল্যাণীয়া জাতটি স্বল্প মেয়াদী উচ্চ ফলনশীল আগাম জাত।
দৌলত ( আর এস-৮১)
বপন থেকে তোলা পর্যন্ত ৯০-১০৫ দিন সময় লাগে। দৌলত জাত খরা ও কিছুটা লবনাক্ততা সহনশীল। বীজে তেলের পরিমাণ ৩৯-৪০%। জাতটি অলটারনারিয়া ব্লাইট রোগ সহনশীল।
বারি সরিষা -৬ (ধলি)
বীজের রং হলদে। কান্ড ও শিকড় শক্ত হওয়ায় গাছ হেলে পড়ে না। পরিপক্ক ফল ফেটে গিয়ে বীজ ঝরে পড়ে না। ফল ও ফলের ঠোঁট তুলনামূলকভাবে লম্বা। বারি সরিষা -৬ (ধলি) পাকতে ৯০-১০০ দিন সময় লাগে। পরিমাণমত সার ও সেচ দিলে প্রতি হেক্টরে ১.৯-২.২ টন ফলন পাওয়া যায়। বীজে তেলের পরিমাণ ৪৪-৪৫%।
বারি সরিষা -৭ (ন্যাপাস-৩১৪২)
গাছের পাতা বোটাহীন ও তল মসৃণ । ফুলের পাঁপড়ির রং সাদা। প্রতি গাছে ফলের সংখ্যা ৯০-১২৫ টি । ফল ২ কক্ষ বিশিষ্ট এবং প্রতি ফলে বীজের সংখ্যা ২৫-৩০ টি।
বারি সরিষা -৮ (ন্যাপাস-৮৫০৯)
ফুলের পাঁপড়ির রং হলদে। প্রতি গাছে ফলের সংখ্যা ৯০-১২৫ টি, ফল ২ কক্ষ বিশিষ্ট । প্রতি ফলে বীজের সংখ্যা ২৫-৩০ টি। বীজের রং কালচে। হাজার বীজের ওজন ৩.৪-৩.৬ গ্রাম। ফসল পাকতে ৯০-৯৫ দিন সময় লাগে।বীজে তেলের পরিমাণ ৪৩-৪৫%। এ জাত অলটারনারিয়া ব্লাইট রোগ ও সাময়িক জলাবদ্দতা সহনশীল।
রাই-৫
প্রতি গাছে ৪-৬ টি প্রাথমিক শাখা থাকে। পাতা বোটাযুক্ত ও খসখসে। প্রস্ফুটিত ফুল কুড়ির নিচে অবস্থান করে।প্রতি গাছে ফলের সংখ্যা ৯০-১২০। বীজে তেলের পরিমাণ ৩৯-৪০%।
বারি সরিষা -৯
এ জাতটি টরি-৭ এর চেয়ে শতকরা ১০-২৫ ভাগ বেশি ফলন দেয়। আমন ধান কাটার পর এবং বোরো ধান চাষের আগে স্বল্প মেয়াদী এ জাতটি সহজে চাষ করা সম্ভব। বীজে তেলের পরিমাণ শতকরা ৪৩-৪৪ ভাগ। ফসল পাকতে ৮০-৮৫ দিন সময় লাগে। পরিমাণমত সার ও সেচ দিলে হেক্টরে ১.২৫-১.৪৫ টন ফলন পাওয়া যায়।
বারি সরিষা -১০
গাছের উচ্চতা ৯০-১০০ সেমি। প্রতি গাছে ৪-৬ টি প্রাথমিক শাখা থাকে। শাখা থেকে প্রশাখা বের হয়। পাতা হালকা সবুজ রংয়ের। পাতা বোটাযুক্ত ও খসখসে । প্রতি গাছে ফলের সংখ্যা ১০০-১২০ টি । ফল ২ কক্ষ বিশিষ্ট । প্রতি পলে বীজের সংখ্যা ১২-১৫ টি । বীজের রং পিঙ্গঁল ।বীজে তেলের পরিমাণ শতকরা ৪২-৪৩ ভাগ। হেক্টর প্রতি ফলন ১.২৫-১.৪৫ টন। আমন ধান কাটার পর এ জাতটি নাবি জাত হিসাবে চাষ করা যায়।
বারি সরিষা -১১
বীজের ওজন অন্যান্য রাই সরিষার চেয়ে বেশি। ফসল ১০৫-১১০ দিন পাকে। প্রতি হেক্টরে ২.০-২.৫ টন ফলন পাওয়া যায়। এ জাতটি দৌলতের চেয়ে ২০-২৫% বেশি ফলন দেয়। আমন ধান কাটার পর এ জাতটি নাবি জাত হিসাবে চাষ করা যায়। জাতটি খরা এবং লবনাক্ত সহনশীল। প্রতি ফলে বীজের সংখ্যা ১২-১৫ টি।অল্টারনেরিয়া রোগ সহনশীল।
বারি সরিষা -১২
বীজে তেলের পরিমাণ ৪৩- ৪৪%। ফসল ৭৮-৮৫ দিনে পাকে। প্রতি হেক্টরে ১.৪৫-১.৬৫ টন ফলন পাওয়া যায়। আমন ধান কাটার পর স্বল্প মেয়াদী জাত হিসেবে চাষ করে বোরো ধান রোপণ করা যায়।
বারি সরিষা-১৩:
হেক্টর প্রতি ফলন ২.২০-২.৮০ টন। ফসল ৯০-৯৫ দিনে পাকে। বীজে তেলের পরিমান শতকরা প্রায় ৪৩ ভাগ।প্রতি গাছে শুটির সংখ্যা ৬৫-৭৫টি। জাতটি সাময়িক জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু।
বারি সরিষা -১৪
ফসল ৭৫-৮০ দিনে পাকে। প্রতি হেক্টরে ১.৪-১.৬ টন ফলন পাওয়া যায়। আমন ধান কাটার পর স্বল্প মেয়াদী জাত হিসেবে চাষ করে বোরো ধান রোপণ করা যায়।প্রতি গাছে শুটির সংখ্যা ৮০-১০০টি শুটি যদিও দেখতে চার প্রকোষ্ট মানে হয় কিন্তু আসলে দুই প্রকোষ্ট বিশিষ্ট।
বারি সরিষা -১৫
উচ্চতা ৯০-১০০ সেঃমি। প্রতি গাছে শুটির সংখ্যা ৭০-৮০টি।ফসল ৮০-৮৫ দিনে পাকে। প্রতি হেক্টরে ১.৫৫-১.৬৫ টন ফলন পাওয়া যায়। আমন ধান কাটার পর স্বল্প মেয়াদী জাত হিসেবে চাষ করে বোরো ধান রোপণ করা যায়।
বারি সরিষা -১৬
উচ্চতা ১৭৫-১৯৫ সেঃ মি।প্রতি গাছে শুটির সংখ্যা ১৮০-২০০টি। ফসল ১০৫-১১৫ দিনে পাকে। প্রতি হেক্টরে ২.০-২.৫ টন ফলন পাওয়া যায়। আমন ধান কাটার পর বোরো ধান করে না এমন জমিতে এ জাতটি নাবি জাত হিসেবে চাষ করা যায়। এ জাতটি খরা ও লবনাক্ততা সহিষ্ঞু।অল্টারনেরিয়া রোগ সহনশীল।
বারি সরিষা -১৭
প্রতি গাছে শুটির সংখ্যা ৬০-৬২টি।ফসল ৮২-৮৬ দিনে পাকে। প্রতি হেক্টরে ১.৭-১.৮ টন ফলন পাওয়া যায়। জাতটি স্বল্প মেয়াদী হওয়ায় রোপা আমন-সরিষা-বোরো ধান শস্য বিন্যাসের জন্য উপযুক্ত।
বিনাসরিষা-৪
বীজের রঙ লালচে কালো এবং বীজে তেলের পরিমাণ ৪৪% । জীবনকাল ৮০-৮৫ দিন। সর্বোচ্চ ২.৪০ টন /হেক্টর ফলন পাওয়া যায়। তবে হেক্টর প্রতি গড় ফলন ১.৭০ টন।
বিনা সরিষা-৭
জাতটি খরা এবং অল্টারনারিয়া জনিত পাতা ও ফলের ঝলসানো রোগ সহনশীল। বীজের আকার তুলনামূলকভাবে বড়। বীজে তেলের পরিমাণ ৩৬-৩৮%। জীবনকাল ১০২-১১০ দিন। হেক্টর প্রতি ফলন ২.০ টন।
বিনা সরিষা-৮
বীজে তেলের পরিমাণ ৩৯-৪১%। জীবনকাল ১০০-১০৮ দিন। হেক্টর প্রতি ফলন ২.৪ টন।
বিনা সরিষা-৯
জাতটি অল্টারনারিয়া জনিত পাতা ও ফলের ঝলসানো রোগ এবং বৃষ্টিজনিত সাময়িক জলাবদ্ধতা সহনশীল। বীজে তেলের পরিমাণ ৪৩%। জীবনকাল ৮০-৮৪ দিন। হেক্টর প্রতি ফলন গড়ে ১.৬০ টন।
বিনা সরিষা-১০
বীজে তেলের পরিমাণ ৪২%। জীবনকাল ৭৮-৮২ দিন। হেক্টর প্রতি ফলন ১.৫ টন।
বীজের হার:
হেক্টর প্রতি ৬-৭ কেজি, বিঘা প্রতি ০.৭-০.৮ কেজি।
বপন পদ্ধতি:
সরিষা বীজ সাধারণত ছিটিয়ে বপন করা হয়। লাইন করে বুনলে সার, সেচ ও নিড়ানী দিতে সুবিধা হয়। লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ১ হাত রাখতে হয়।
জমি তৈরি পদ্ধতি
জমি ২-৩টি চাষ দিয়ে তৈরি করতে হবে৷ চাষ কম হলে সরিষা বীজের অঙ্কুরোদগমে বিঘ্ন ঘটে৷ মাটির জো অবস্থায় জমি চাষ দিতে হবে৷ এতে মাটিতে ঢেলা থাকবে না, মাটি সমতল হবে৷ জমি চাষ করার সময় আগাছা ভালোভাবে বাছাই করতে হবে, যাতে ফসলে আগাছার প্রকোপ কম হয়৷ সরিষা জমির চাষ ১০-১২ সেন্টিমিটার গভীরে হওয়া দরকার৷ সরিষা জমিতে চাষ করার ফাঁকে ফাঁকে রোদ লাগতে হবে৷ভালোভাবে চাষ-মই দিয়ে জমি সমতল করতে হবে৷
বীজ শোধন:
প্রোভ্যাক্স দিয়ে (২-৩ গ্রাম ছত্রাক নাশক/ কেজি বীজ) এবং বিনা সরিষার বীজ কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক (২.৫ গ্রাম/ কেজি) দিয়ে শোধন করতে হবে৷
বপনের সময়:
অঞ্চলভেদে এবং জমির জো অবস্থা অনুযায়ী বীজ মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য কার্তিক মাস পর্যন্ত বোনা যায়। রাই-৫ এবং দৌলত কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত বপন করা যেতে পারে।
নিড়ানী দেয়া:
বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পর একবার এবং ফুল আসার সময় দ্বিতীয়বার নিড়ানি দিতে হয়।
সেচ প্রয়োগ:
বীজ বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে (গাছে ফুল আসার সময়) প্রথম সেচ এবং ৫০-৫৫ দিসের মধ্যে (ফল ধরার সময়) দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে। বপনের সময় মাটিতে রস কম থাকলে চারা গজানোর ১০-১৫ দিনের মধ্যে একটি হালকা সেচ দিতে হয়।
সারের পরিমান:
জাত, মাটি এ মাটিতে রসের তারতম্য অনুসারে সার দিতে হয়।
শতাংশ প্রতি সারের পরিমাণ
ইউরিয়া-১০০০গ্রাম,
টিএসপি-৭০০গ্রাম,
এমপি- ৩৫০গ্রাম,
জিঙ্ক সালফেট - ০-২০গ্রাম,
জিপসাম-৬০০গ্রাম,
বোরিক এসিড-৪-৬গ্রাম,
ডলোচুন - ১৩৫০গ্রাম,
সুষম কম্পোস্ট - ৮-১০কেজি,
গোবর- ৩০কেজি, খৈল- ৪ কেজি
জমিতে নির্বাচিত হারে সুষম কম্পোস্ট দেওয়া হলে সেখানে সাধারণ গোবর বা খৈল দেওয়ার প্রয়োজন হয় না৷
সার প্রয়োগ পদ্ধতি :
ইউরিয়া বীজ বপনের ৩০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে ১-২ বার প্রয়োগ করতে হবে৷
ইউরিয়ার ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে৷
ইউরিয়ার দেওয়ার পূর্বে জমির আগাছা দমন করতে হবে৷
অর্ধেক ইউরিয়া ও অন্যসব সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে৷
ইউরিয়ার উপরিপ্রয়োগের পর জমিতে সেচ দিতে হবে৷
ফসল সংগ্রহ:
শুটি যখন খড়ের রং ধারণ করবে তখনই ফসল কাটতে হবে। যখন সরিষা গাছের শুটি শতকরা ৭০-৭৫ভাগ পাকে তখন ফসল কর্তনের উপযোগী সময়।

