টমেটোর চাষ পদ্ধতি
টমেটোর চাষ পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা
![]() |
| টমেটোর চাষ পরিচিতি |
ভূমিকাঃ
বাংলাদেশে টমেটো অতি জনপ্রিয় শীতকালীন ফসল। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট গ্রীষ্মকালে উৎপাদনের উপযোগী কয়েকটি টমেটোর জাত অবমুক্ত করেছে। সারাবছরই এ সবজির ব্যাপক চাহিদা থাকায় এ জাতগুলির চাষাবাদ শুরু হলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত টমেটো দিয়েই টমেটোর প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে ।
টমেটো খেতে সুস্বাদু ও একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ সবজি । ১০০ গ্রাম ভক্ষণপযোগী পাকা টমেটোতে ৯৪ গ্রাম জলীয় অংশ, ০.৫ গ্রাম মোট খনিজ, ০.৮ গ্রাম আঁশ, ০.৯ গ্রাম আমিষ, ০.২ গ্রাম স্নেহ, ৩.৬ গ্রাম শর্করা থাকে। উল্লেখযোগ্য খনিজ ও খাদ্য উপাদানের মধ্যে ক্যালসিয়াম ৪৮ মি.গ্রা., লৌহ ০.৪ মি.গ্রা., ক্যারোটিন ৩৫৬ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন বি- ১ ০.১২ মি.গ্রা., ভিটামিন বি-২ ০.০৬ মি.গ্রা. ও ভিটামিন সি ২৭ মি.গ্রা. রয়েছে।
পরিচিতিঃ
বাংলা নামঃ টমেটো।
ইংরেজী নামঃ Tomato.
বৈজ্ঞানিক নামঃ Lycopersicon esculentum.
পরিবারঃ Solanaceae.
জীবনকালঃ
টমেটোর ১২০-১৫০ দিন।
জলবায়ু ও মাটিঃ
টমেটো এদেশে শীতকালীন ফসল। উচ্চ তাপমাত্রা এবং বাতাসের আর্দ্রতা টমেটো গাছের রোগ বিস্তারে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। আবার উচ্চ তাপমাত্রা ও শুষ্ক আবহাওয়ায় ফুল ঝরে যায়। রাতের তাপমাত্রা ২৩০ সে. এর নিচে থাকলে ফুল ও ফল ধারণের জন্য বেশী উপযোগী। গড় তাপমাত্রা ২০০-২৫০ সে. এ টমেটোর ভাল ফলন হয়।
আলো বাতাসযুক্ত উর্বর দোআঁশ মাটি টমেটো চাষের জন্য সবচেয়ে ভাল। তবে উপযুক্ত পরিচর্যায় বেলে দোআঁশ থেকে এঁটেল দোআঁশ সব মাটিতেই টমেটো ভাল জন্মে। বন্যার সময় পলি জমে এমন জমিতে এর ফলন সবচেয়ে বেশী। মাটির অম্লতা ৬-৭ হলে ভাল হয়। মাটির অম্লতা বেশী হলে চুন প্রয়োগ করা উচিত।
জাতসমূহঃ
বর্তমানে আমাদের দেশে উদ্ভাবিত ও আমদানীকৃত বেশকিছু শীতকালীন ও গ্রীস্মকালীন জাতের টমেটোর আবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বারি টমেটো-২ (রতন), বারি টমেটো-৩, বারি টমেটো-৬ (চৈতী), বারি টমেটো-১০ (অনুপমা) ইত্যাদি জাতগুলো শীত মৌসুমে এবং বারি টমেটো-৪,৫, ৬ এবং বারি টমেটো-৯ (লালিমা), গ্রীস্ম মৌসুমে চাষ করা যায়। বারি টমেটো-৬ (চৈতী) জাতটি উভয় মৌসুমেই চাষ করা যায়। এছাড়া শীতকালে চাষযোগ্য অন্যান্য জনপ্রিয় জাত হলো সুপ্রীম সীড কোম্পানীর হাইব্রিড টমেটো এস্ট্রা, হাইব্রিড টমেটো নোভা, ব্রাক সীড এন্টারপ্রাইজের হাইব্রিড জাত তৃপ্তি,নামধারী মালিক সীডস্ এর (রোমা,সুরক্ষা,),ইস্পাহানী সীডস্ এর রতন,ম্যাগস ইকো আর্থ লিমিটেডের(মী রেড রোজ,মী রেড প্রিন্স), এ.আর.মালিক এ্যান্ড কোং (প্রাঃ) লিঃ এর (জেসিকা, ইপক,ডায়নামো,রেডহিট), হাইটম, রুপালি ইত্যাদি।
বীজ বপন ও চারা উৎপাদনঃ
উন্নতমানের ও সুস্থ্য সবল চারা উৎপাদনের জন্য প্রথমে বীজতলায় চারা উৎপাদন করে নিতে হবে। প্রচুর সূর্যালোক, খোলামেলা স্থানে এবং বেলে দো-আঁশ মাটিতে একটু উঁচু করে বীজতলা তৈরী করা উত্তম। নির্দিষ্ট পরিমাপের (২০ গ্রাম) বীজ গজানোর জন্য বীজতলা সাধারণত ৩ মিটার লম্বা এবং ১ মিটার প্রস্থের হয়ে থাকে। তবে বীজের পরিমান বেশী হলে আনুপাতিক হারে বীজতলার প্রস্থ অপরিবর্তিত রেখে দৈর্ঘ্য বাড়ানো যেতে পারে। বীজতলার চারা গোড়া পচা ও ড্যাম্পিং অফ রোগ হতে রক্ষা করার জন্য বীজ বপনের পূর্বে মাটি শোধন করে নিতে হবে।
আমাদের দেশে খড়কুটা জ্বালিয়ে সরাসরি তাপ দিয়ে, সৌরতাপে এবং রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগে (প্রতি ১ ভাগ ফরমালডিহাইড এর সাথে ৫০ ভাগ পানি মিশিয়ে প্রতি বর্গমিটারে ১২ লিটার হারে) বীজতলার মাটি শোধন করা যেতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে সুস্থ্য সবল চারা প্রাপ্তির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বীজতলায় চারা স্থানান্তর করে টমেটো চারা উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে প্রথম বীজতলায় ৫০ গ্রাম বীজ ঘন করে বপন করতে হয়। বীজ গজানোর ৮-১০ দিন পর গজানো চারা দ্বিতীয় বীজতলায় (৪ x ৪ সে.মি দুরত্বে) স্থানান্তর করতে হয়। আগাম চাষের জন্য আগষ্ট মাসেই বীজ বপন করতে হয়। নাবি জাতের টমেটো চাষের জন্য নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত বীজ বপন করা যায় । প্রতি হেক্টর জমির জন্য ১৫০-১৭৫ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
জমি তৈরীঃ
টমেটোর ভাল ফলন অনেকাংশেই জমি তৈরীর উপর নির্ভর করে। তাই ৪-৫ বার চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। মাটির প্রকৃতি ও স্থানভেদে ১ মি. চওড়া ও ১৫-২০ সে.মি. উঁচু বেড তৈরী করতে হবে। দুটি বেডের মাঝখানে ৩০ সে.মি. নালা করতে হবে যাতে পানি সেচ ও নিষ্কাশনের জন্য সুবিধা হয়।
বীজ বপনের সময়ঃ
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর (শীতকাল), মে-জুলাই (গ্রীষ্ম-বর্ষাকালে)।
বীজের মাত্রাঃ
২০০ গ্রাম/হেক্টর (১ গ্রাম/শতাংশ)
চারা উৎপাদনঃ
সবল চারা উৎপাদনের জন্য প্রথমে ৫০ গ্রাম সুস্থ বীজ ঘন করে প্রতিটি বীজতলায় (১মি.*৩মি.) বুনতে হবে। এই হিসাবে প্রতি হেক্টরে ২০০ গ্রাম (১ গ্রাম/শতাংশ) বীজ বুনতে (গজানোর হার ৮০%) ৪ টি বীজতলার প্রয়োজন।
গজানোর ৮-১০ দিন পর চারা দ্বিতীয় বীজতলায় ৪৪ সে.মি. দূরত্বে স্থানান্তর করতে হবে।
এক হেক্টর জমিতে টমেটো চাষের জন্য এইরুপ ২২ টি বীজতলার প্রয়োজন হয়।
বীজতলায় ৪০-৬০ মেস (প্রতি ইঞ্চিতে ৪০-৬০ টি ছিদ্রযুক্ত) নাইলন নেট দিয়ে ঢেকে চারা উৎপাদন করলে চারা অবস্থায়ই সাদা মাছি পোকার দ্বারা পাতা কোঁকড়ানো ভাইরাস রোগ ছড়ানোর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যায়। এরুপ সুস্থ সবল ও ভাইরাসমুক্ত চারা রোপন করে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
অতিরিক্ত বৃষ্টি ও রোদের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজনে পলিথিন ও চাটাই এর আচ্ছাদন ব্যবহার করতে হবে।
চারা রোপণঃ
চারার বয়স ৩০-৩৫ দিন অথবা ৪-৬ পাতা বিশিষ্ট হলে জমিতে রোপন করতে হবে।
এক মিটার বেডে দুই সারি করে চারা লাগাতে হবে। এক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০ সে.মি. এবং সারিতে চারা থেকে চারা ৪০ সে.মি. দূরত্বে লাগাতে হবে।
বীজতলা থেকে চারা অত্যন্ত যত্ন সহকারে তুলতে হবে যেন চারার শিকড় ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। এ জন্য চারা তোলার আগে বীজতলার মাটি ভিজিয়ে নিতে হবে।
বিকেলের পড়ন্ত রোদে চারা রোপণ করাই উত্তম এবং লাগানোর পর গোড়ায় হালকা সেচ প্রদান করতে হবে।
সেচ ও নিষ্কাশনঃ
চারা রোপণের ৩-৪ দিন পর পর্যন্ত হালকা সেচ ও পরবর্তীতে প্রতি কিস্তি সার প্রয়োগের পর জমিতে সেচ দিতে হয়। গ্রীষ্ম মৌসুমে টমেটো চাষের জন্য ঘন ঘন সেচের প্রয়োজন হয়। বর্ষা মৌসুমে তেমন একটা সেচের প্রয়োজন হয় না। টমেটো গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারেনা। সেচ অথবা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য নালা পরিমিত চওড়া (৩০-৪০ সে.মি.) এবং এক দিকে সামান্য ঢালু হওয়া বাঞ্ছনীয়।
মালচিংঃ
প্রতিটি সেচের পরে মাটির উপরিভাগের চটা ভেঙ্গে দিতে হবে। যাতে মাটিতে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে।
আগাছা দমনঃ
টমেটোর জমিতে প্রয়োজন মত নিড়ানী দিয়ে আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
সার উপরি প্রয়োগঃ
সময়মত বর্নিত মাত্রায় প্রয়োজনীয় সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
সার প্রয়োগঃ-১ (কেজি/শতাংশ)
| সারের নাম | সার দেওয়ার সময় | জমির উর্বরা শক্তি | ||
|---|---|---|---|---|
| কম | মধ্যম | বেশি | ||
| গোবর সার | জমি তৈরীর সময় | ৬০ | ৪০ | ২০ |
| টিএসপি সার | জমি তৈরীর সময় | ১ | ০.৮ | ০.৬ |
| সারের নাম | সার দেওয়ার সময় | জমির উর্বরা শক্তি | ||
|---|---|---|---|---|
| কম | মধ্যম | বেশি | ||
| এমওপি | শেষ চাষের সময় | ০.৪ | ০.৩৫ | ০.৩ |
সার প্রয়োগঃ-৩ (কেজি/শতাংশ)
| সারের নাম | সার দেওয়ার সময় | জমির উর্বরা শক্তি | ||
|---|---|---|---|---|
| কম | মধ্যম | বেশি | ||
| ইউরিয়া ১ম উপরি প্রয়োগ | চারা লাগানোর ১০ দিন পর | ০.৬ | ০.৪ | ০.৩ |
সার প্রয়োগঃ-৪ (কেজি/শতাংশ)
| সারের নাম | সার দেওয়ার সময় | জমির উর্বরা শক্তি | ||
|---|---|---|---|---|
| কম | মধ্যম | বেশি | ||
| ইউরিয়া ২য় উপরি প্রয়োগ | চারা লাগানোর ২৫ দিন পর | ০.৬ | ০.৪ | ০.৩ |
| এমওপি ১ম উপরি প্রয়োগ | চারা লাগানোর ২৫ দিন পর | ০.৩ | ০.৩ | ০.২৫ |
| সারের নাম | সার দেওয়ার সময় | জমির উর্বরা শক্তি | ||
|---|---|---|---|---|
| কম | মধ্যম | বেশি | ||
| ইউরিয়া ৩য় উপরি প্রয়োগ | চারা লাগানোর ৪০ দিন পর | ০.৬ | ০.৪ | ০.৩ |
| এমওপি ২ম উপরি প্রয়োগ | চারা লাগানোর ৪০ দিন পর | ০.৩ | ০.২৫ | ০.২ |
