পেঁয়াজ চাষ পদ্ধতি
পেঁয়াজ(Allium cepa) চাষ পদ্ধতি
![]() |
| পেঁয়াজ |
পেঁয়াজ গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই পেঁয়াজের চাষ দেখা যায়। পেঁয়াজের চাষ শুধু শীতকালেই হয় না এখন গ্রীষ্মকালেও চাষ করা হচ্ছে।
উপযুক্ত জমি ও মাটিঃ
উর্বর বেলে-দো-আঁশ মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য অতি উত্তম। গ্রীষ্মে পেঁয়াজ চাষের জন্য উঁচু জমি দরকার যেখানে বৃষ্টির পানি জমেনা। জমিতে সেচ ও পানি নিকাশের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
পেঁয়াজের জাত:
এ দেশে এখনও দেশী জাতের পেঁয়াজের চাষাবাদ হয়ে আসছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র হতে বারি পেঁয়াজ-১ (শীতকালীন), বারি পেঁয়াজ-২, (গ্রীষ্মকালীন), বারি পেঁয়াজ-৩ (গ্রীষ্মকালীন), বারি পেঁয়াজ-৪ (শীতকালীন), বারি পেঁয়াজ-৫(গ্রীষ্মকালীন) ও বারি পেঁয়াজ-৬ (শীতকালীন) নামে ৬টি জাত মুক্তায়িত হয়েছে।
স্থানীয় জাতঃ
স্থানীয় জাতের মধ্যে তাহেরপুরী, ফরিদপুরের ভাতি, ঝিটকা, কৈলাসনগর উল্লেখযোগ্য। আগাম রবি মৌসুমে এ জাত দুটির ফলন দ্বিগুন হয় এবং কন্দের মানও উন্নত হয়। উদ্ভাবিত ও উল্লেখিত পেঁয়াজের জাত দুইটি উত্তরবঙ্গ, কুষ্টিয়া, যশোর ও ফরিদপুর অঞ্চলে ব্যবসায়িক ভাবে চাষ করার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
হাইব্রিড জাতঃ
বর্তমানে লাল তীর, সুপ্রিম সিড সহ কয়েকটি কোম্পানি হাইব্রিড জাতের পেঁয়াজের বীজ মার্কেটিং করে৷ অধিক ফলন পেতে এ জাতগুলো কৃষক এর নজরে রয়েছে৷
ভাল বীজের বৈশিষ্ট্যঃ
# ভাল বীজ হাত নিয়ে চাপ দিলে চাপ বসবে না। খারাপ বীজ হলে চাপ বসবে।
# মুখে নিয়ে দাঁত দিয়ে চাপ দিলে ভাল বীজ হলে ভেঙ্গে যাবে। খারাপ বীজ হলে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে।
# পানিতে দিলে ভাল হলে পানিতে ডুবে যাবে। খারাপ হলে ভেসে উঠবে।
![]() |
| পেঁয়াজ |
চারা তৈরিঃ
৩x১ মিটার(৯.৮৪ফুট × ৩.২৮ ফুট) আকারের প্রতি বীজতলার জন্য ২৫-৩০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। পেঁয়াজ রবি ও খরিপ মৌসুমে চাষ করা যায়। খরিপ মৌসুমে চাষের জন্য জুলাই-আগষ্ট (শ্রাবণ-ভাদ্র) ও রবি মৌসুমে চাষের জন্য অক্টোবর-নভেম্বর বা ফেব্রুয়ারী-মার্চ (মাঘ-ফাল্গুন) মাসে বীজ তলায় বীজ বপন করতে হয়। বিঘা প্রতি বীজ ৪৫০-৫০০ গ্রাম, ছিটালে ৬০০-৮০০ গ্রাম প্রয়োজন, এছাড়াও নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে কন্দ রোপন করে আগাম ফলন বের করে লাভবান হওয়া যায়৷ সেক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ বা বিঘার জন্য ৬৫-৭৫ কেজি কন্দের প্রয়োজন পড়ে৷
বাজারে ছোট/মাঝারী ২ ধরনের কন্দ পাওয়া যায়৷ বীজের ক্ষেত্রে, জমির আগাছা পরিষ্কার করে ভালভাবে চাষও মই দিয়ে ৩x১ মিটার আকারের বীজতলা করে এক সপ্তাহ রাখা হয়। বীজ বপনের পূর্বে আগের দিন সন্ধ্যায় বীজ ভিজিয়ে রেখে পরের দিন তুলে ১ ঘন্টা রৌদ্রে শুকিয়ে তারপর বীজতলায় বপন করতে হবে। বীজ বপনের পর ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে। বীজ বপনের পরদিন বেডে ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দিনের বেলা বীজতলা ঢেকে রাখতে হবে এবং রাত্রে খোলা রাখতে হবে। প্রয়োজনে ঝরনা দিয়ে পানি দিতে হবে।
চারা রোপনঃ
৩/৪টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করা হয়। ১৫x১০ সে.মি. দূরত্বে চারা রোপন করা হয়। বর্ষার সময় ১ মিটার চওড়া ও ১৫ সে.মি. উঁচু বেড তৈরি করে চারা রোপণ করা হয়। দুই বেডের মাঝে ৩০ সে.মি. চওড়া পানি নিকাশের নালা রাখা হয়। ৪০-৪৫ দিন বয়সের চারা লাগানোর উপযোগী হয়।
সার ব্যবস্থাপনাঃ
পেঁয়াজের জমিতে প্রতি বিঘায়/৩৩ শতাংশে গোবর ৩০ মন, ইউরিয়া ৩৩ কেজি, টিএসপি/ড্যাপ ২৫ কেজি, ২০ কেজি এমওপি, ১০ কেজি জিপসাম, ফুরাডান ২ কেজি, কার্বেন্ডাজিম ১ কেজি, ১ কেজি সলুবোরন, ১ কেজি চিলেটেড জিংক সার প্রয়োগ করা হয়। জমি তৈরির সময় ১৫ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি এমওপি ও বাকী সমুদয় সার মাটিতে মেশাতে হয়। চারা রোপনের ২৫ ও ৪৫ দিন পর বাকী ইউরিয়া ও এমওপি সার ২ ভাগে উপরি প্রয়োগ করা হয়।
সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনাঃ
জমিতে রসের অভাব থাকলে সেচ দিতে হবে। বর্ষা মৌসুমে যাতে বৃষ্টির পানি দাঁড়াতে না পারে সেজন্য নিকাশ নালা রাখতে হবে। জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। সেচের পর জমি নিড়ানি দিয়ে আলগা করে দিতে হবে। পেঁয়াজের কন্দ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফুলের কুঁড়ি দেখামাত্র ভেঙ্গে দিতে হবে।
রোগ ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনাঃ
পোকার নামঃ থ্রিপস।
এ পোকা ছোট কিন্তু পাতার রস চুষে খায় বিধায় গাছ দূর্বল হয়ে পড়ে। সে কারনে ক্ষেতের মধ্যে পাতা বিবর্ণ দেখলে কাছে গিয়ে মনোযোগ সহকারে দেখা উচিৎ, তা না হলে ফলন অনেক কমে যাবে। পোকা আকৃতিতে খুব ছোট। স্ত্রী পোকা সরু, হলুদাভ। পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ গাঢ় বাদামী। বাচ্চা সাদা বা হলুদ। এদের পিঠের উপর লম্বা দাগ থাকে।
ক্ষতির নমুনাঃ
এরা রস চুষে খায় বলে আক্রান্ত পাতা রূপালী রং ধারণ করে। আক্রান্ত পাতায় বাদামী দাগ বা ফোঁটা দেখা যায়। অধিক আক্রমণে পাতা শুকিয়ে যায় ও ঢলে পড়ে। রাইজোম আকারে ছোট ও বিকৃত হয়।
জীবন চক্রঃ
স্ত্রী পোকা পাতার কোষের মধ্যে ৪৫-৫০ টি ডিম পাড়ে। ৫-১০ দিনে ডিম হতে নিম্ফ (বাচ্চা) বের হয়। নিম্ফ ১৫-৩০ দিনে দুটি ধাপ অতিক্রম করে। প্রথম ধাপে খাদ্য গ্রহণ করে এবং দ্বিতীয় ধাপে খাদ্য গ্রহণ না করে মাটিতে থাকে। এরা বছরে ৮ বার বংশ বিস্তার করে। এবং স্ত্রী পোকা পুরুষ পোকার সাথে মিলন ছাড়াই বাচ্চা দিতে সক্ষম।
ব্যবস্থাপনাঃ
নীল বা সাদা রংয়ের আঠালো ফাঁদ ব্যবহার। ক্ষেতে মাকড়সার সংখ্যা বৃদ্ধি করে এ পোকা দমন করা যায়। আক্রমণ বেশি হলে এন্ট্রাপিড(পদ্মা) ১ মিলি/১ লি/প্যাগাসাস(সিনজেন্টা)/বায়োট্রিন (ইস্পাহানি )গাছে ৭ থেকে ১০ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
পোকার নামঃ জাব পোকা
ক্ষতির নমুনাঃ
জাব পোকা দলবদ্ধভাবে পেঁয়াজ পাতার রস চুষে খায়, ফলে গাছ দূর্বল ও হলুদাভ হয়ে যায়। জাব পোকার মলদ্বার দিয়ে যে তরল পদার্থ বের হয় তাকে ’হানিডিউ’ বলে যা পাতায় আটকে গেলে সুটি মোল্ড নামক কালো ছত্রাক জন্মায়। ফলে গাছের সবুজ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ব্যবস্থাপনাঃ
হলুদ আঠালো ফাঁদমনদ বেশ কার্যকরী৷ আক্রমণ বেশি হলে ইমাডিক্লোরোপিড গ্রুপের ঔষধ টিডো/ইমিটাফ/এডমায়ার প্রতি লিটারে ১ মিলি কিংবা ক্যারাটে/এলিকা ৭ থেকে ১০ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
রোগসমূহঃ
পার্পল ব্লচ/ব্লাইটঃ
এ রোগ পেঁয়াজের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। যে কোন বয়সে গাছের পাতা ও কান্ড আক্রান্ত হয়। অধিক আক্রমনে পেঁয়াজে ফুল আসে না ও ফসল কম হয়। আক্রান্ত বীজ বেশিদিন গুদামে রাখা যায়না। বাজার মূল্য কমে যায়। অল্টারনারিয়া পোরি ও স্টেমফাইলিয়াম বট্রাইওসাম নামক ছত্রাকদ্বয় দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
ক্ষতির লক্ষণঃ
কান্ডে প্রথমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পানি ভেজা হালকা বেগুনী রংয়ের দাগের সৃষ্টি হয়। দাগগুলি বৃদ্ধি পেয়ে বড় দাগে পরিণত হয় এবং আক্রান্ত স্থান খড়ের মত হয়ে শুকিয়ে যায়। আক্রান্ত পাতা ক্রমান্বয়ে উপরের দিক হতে মরতে শুরু করে। পাতা বা কান্ডের গোড়ায় আক্রান্ত স্থানের দাগ বৃদ্ধি পেয়ে হঠাৎ পাতা বা বীজবাহী কান্ড ভেঙ্গে পড়ে এতে বীজ অপুষ্ট হয় ও ফলন কম হয়। বৃষ্টিপাত হলে এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। আক্রান্ত বীজ, গাছের পরিত্যাক্ত অংশ ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে।
দমন ব্যবস্থাপনাঃ
রোগ প্রতিরোধী বা সহনশীল জাত ব্যবহার। রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার। ফসল পর্যায় অনুসরন করা অর্থ্যাৎ একই জমিতে পর পর কমপক্ষে ৪ বছর পেঁয়াজ চাষ না করা। পেঁয়াজ গাছের পরিত্যাক্ত অংশ, আগাছা ধ্বংস করা।
প্রোভ্যাক্স বা অটোষ্টিন (কার্বেন্ডাজিম) ছত্রাকনাশক প্রতি কেজি বীজে ৩ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধণ করে বপন করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে প্রতিলিটার পানিতে রোভরাল বা এন্ট্রাকল ২ গ্রাম বা ফলিকিউর (টেবুকোনাজল) ১০ লিটার পানিতে ৫ মিলি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
কান্ড পঁচা রোগঃ
স্কেলরোসিয়াম রলফসি ও ফিউজারিয়াম নামক ছত্রাক দ্ধারা এ রোগ হয়। যে কোন বয়সে গাছ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। কন্দ ও শিকড়ে এর আক্রমণ দেখা যায়। আক্রান্ত কন্দে পচন ধরে এবং আক্রান্ত কন্দ গুদামজাত করে বেশী দিন রাখা যায় না।
ক্ষতির প্রকৃতিঃ
আক্রান্ত গাছের পাতা হলদে হয়ে যায় ও ঢলে পড়ে। টান দিলে আক্রান্ত গাছ খুব সহজে মাটি থেকে কন্দসহ উঠে আসে। আক্রান্ত স্থানে সাদা সাদা ছত্রাক এবং বাদামী বর্ণের গোলাকার ছত্রাক গুটিকা (স্কেলরোসিয়াম ) দেখা যায়। অধিক তাপ ও আর্দ্রতা পূর্ণ মাটিতে এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। ক্ষেতে সেচ দিলেও এ রোগ বৃদ্ধি পায়। এ রোগের জীবাণু মাটিতে বসবাস করে বিধায় সেচের পানির মাধ্যমে ও মাটিতে আন্ত পরিচর্যার সময় কাজের হাতিয়ারের মাধ্যমে এ রোগের বিস্তার হয়।
দমন ব্যবস্থাপনাঃ
আক্রান্ত গাছ তুলে ধ্বংশ করতে হবে। মাটি সব সময় স্যাঁত স্যাঁতে রাখা যাবে না। আক্রান্ত জমিতে প্রতি বছর পেঁয়াজ /রসুন চাষ করা যাবে না। প্রোভ্যাক্স বা অটোষ্টিন (কার্বেন্ডাজিম) ছত্রাকনাশক প্রতি কেজি বীজে ৩ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধণ করে বপন করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে প্রতিলিটার পানিতে রোভরাল বা এন্ট্রাকল ২ গ্রাম বা ফলিকিউর (টেবুকোনাজল) ১০ লিটার পানিতে ৫ মিলি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ফসল সংগ্রহঃ
উপযোগী বৈশিষ্ট্যঃ
পেঁয়াজ গাছ পরিপক্ক হলে পাতা ক্রমান্বয়ে হলুদ হয়ে হেলে পড়ে। জমির প্রায় ৭০-৮০% গাছের এ অবস্থা হলে পেঁয়াজ তোলার উপযোগী হয়।
সংগ্রহের সময়ঃ
পেঁয়াজ গাছের ঘাড় বা অগ্রভাগ শুকিয়ে ভেঙ্গে গেলে বা নরম মনে হলে বুঝতে হবে যে পেঁয়াজের উত্তোলনের সময় হয়েছে।
কতদিন লাগবেঃ
বীজ বপন থেকে ফসল উত্তোলন পর্যন্ত প্রায় পেঁয়াজ চাষে মোট ১১০-১২০ দিন সময় লাগে।
ফলনঃ
সাধারণত বর্ষা মৌসুমে ৩৫-৪৫ দিন এবং রবি মৌসুমে ৪০-৫৫ দিনের মধ্যে পেঁয়াজ তোলার উপযুক্ত হয়। রবি মৌসুমে পেঁয়াজের পাতা মরে গেলে (গলা চিকন হলে) গাছসহ পেঁয়াজ তুলে এনে পাতা শুকিয়ে মরা পাতা কেটে সংরক্ষণ করা হয়। প্রতি হেক্টরে ফলন রবিতে ১২-১৬ টন ও খরিপ ১০-১২ টন।
পুষ্টিমূল্য ও ভেষজ গুণঃ
এতে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও সামান্য ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে।
এটি উত্তেজক হিসেবে কাজ করে, শ্বাসনালীর মিউকাস কমায়, হজমি নালার জ্বালা কমায়, রক্ত পরিশোধন করে, এ্যাজমা ও কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়, পোকার কামড়ে বিশুদ্ধ মধুসহ প্রলেপ দিলে জ্বালা কমায়, কাঁচা পেঁয়াজের রস চুলের বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

