আলুর মড়ক/নাবী ধ্বসা( Late blight) রোগ ও দমন ব্যবস্থাপনা
আলুর মড়ক/নাবী ধ্বসা( Late blight) রোগ
![]() |
| আলুর মড়ক/নাবী ধ্বসা( Late blight) |
আলুর সবচেয়ে মারাত্মক রোগ late blight। এই রোগে বেশি আক্রান্ত হলে ৬০-৭০% পর্যান্ত ফলন কমে যায়।১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে আলুর চাষাবাদ বিস্তারের পাশাপাশি এ রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকে।
♥ আলুর মড়ক/নাবী ধ্বসা রোগের কারণ
(phytophthora infestans) নামক ছত্রাকের আক্রমণে এই রোগ হয়।মেঘাচ্ছন্ন ও আর্দ্র পরিবেশে এই রোগের জন্য অনুকূল পরিবেশ।
♥ মড়ক/নাবী ধ্বসা রোগ বিস্তারে অনুকূল আবহাওয়া
>> নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের (মধ্য কার্তিক থেকে মধ্য ফাল্গুন) যে কোন সময় নিম্ন তাপমাত্রা (রাতে ১০-১৬ ডিগ্রি এবং দিনে ১৬-২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এবং কুয়াশাচ্ছন্ন আর্দ্র আবহাওয়া (আর্দ্রতা ৯০% এর বেশি) এ রোগ বিস্তারের জন্য অনুকূল।
>> কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হলে এ রোগ ২-৩ দিনের মধ্যে মহামারী আকার ধারণ করে। বাতাস, বৃষ্টিপাত ও সেচের পানির সাহায্যে এ রোগের জীবাণু আক্রান্ত গাছ থেকে সুস্থ গাছে দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
>>কুয়াশাচ্ছন্ন স্যাতস্যাতে কিংবা উঠতি সেচের জন্য পাতা ৬-১২ ঘন্টার মতো ভেজা থাকলে ও মাঝারি তাপমাত্রা (১৫-৩০)° এবং বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকলে রোগের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
♥ মড়ক/নাবী ধ্বসা রোগ চেনার লক্ষণঃ
✳️প্রাথমিক পর্যায়ে, আক্রান্ত টিউবার/আলু থেকে গাছ বের হলে নিচের দিকের কান্ডে বাদামী কালচে দাগ দেখা যায়।
✳️মড়ক রোগের আক্রমণে প্রথমে আলু গাছের গোড়ার দিকের পাতায় ছোপ ছোপ ভেজা হালকা সবুজ গোলাকার বা বিভিন্ন আকারের দাগ দেখা যায়।
✳️দাগগুলোর মাঝখানে বাদামী, বাইরের দিকে দিয়ে হলুদ টিস্যু দ্বারা ঘেরা থাকে। কেননা পাতার টিস্যুগুলোকে মেরে ফেলে বাদামী থেকে কালচে বেগুনী রং ধারণ করে।
✳️সকালে মাঠ পরির্দশন করলে আক্রান্ত পাতার নিচে সাদা সাদা পাউডারের মত ছত্রাকের জীবাণুর উপস্থিতি দেখা যায়।
✳️ঠাণ্ডা ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় আক্রান্ত গাছ দ্রুত পচে যায়।এই অবস্থায় ২-৩ দিনের মধ্যেই ক্ষেতের সমস্ত গাছ মরে যেতে পারে।
✳️আক্রান্ত আলুর গায়ে ও ভিতরের অংশে গাঢ় বাদামী থেকে কালচে বর্ণের দাগ পড়ে।
✳️হিমাগারে রাখা আলুতে এই রোগের জীবাণু সুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং গাছ গজানোর ৪৫-৫০ দিন পর অনুকূল পরিবেশে এই রোগের সূচনা হতে পারে।
♥ মড়ক/নাবী ধ্বসা রোগ হওয়ার পূর্বে প্রতিরোধের উপায়ঃ
√√ আগাম জাতের আলু চাষ করা।অর্থাৎ ১৫ নভেম্বরের মধ্যে আলু রোপণ।পাশাপাশি জীবাণু প্রতিরোধী জাত যেমন-বারী আলু-৪৬,৫৩,৭৭চাষ করা।
√√ নিরোগ certified, grade আলুর বীজ লাগাতে হবে। বীজ শোধনের জন্য Carbendazim 50WP ১লিটার পানিতে ৩ গ্রাম মিশিয়ে ১ কেজি বীজে ব্যবহার করতে হবে।
√√ আলুর মৌসুমে নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন করতে হবে।
√√ আক্রান্ত গাছ/ অংশ কেটে কাচি দিয়ে মাটিতে দূরে পুতে ফেলতে হবে।
√√ আলুর সারি হতে সারির দূরত্ব ৬০ সেন্টিমিটার এবং প্রতি সারিতে আলু হতে আলুর দূরত্ব আস্ত বীজ আলুর ক্ষেত্রে ২৫ সেন্টিমিটার আর কাটা আলুর ক্ষেত্রে ১৫ সেন্টিমিটার অনুসরণ করতে হবে।
√√ আলুর সারিতে ভালভাবে মাটি উঁচু করে দিতে হবে। সেচের পর আলু গাছের গোড়ার মাটি সরে গেলে তা মাটি দিয়ে পুনরায় ঢেকে দিতে হবে।
⚠️নিম্ন তাপমাত্রা, কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও বৃষ্টির পূর্বাভাস পাওয়ার সাথে সাথে রোগ প্রতিরোধের জন্য ৭-১০ দিন অন্তর ম্যানকোজেব গ্রুপের অনুমোদিত ছত্রাকনাশক যেমন- ডাইথেন এম-৪৫, ইন্ডোফিল এম-৪৫ বা পেনকোজেব ৮০ ডব্লিউপি প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করে গাছ ভালভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।
♥ মড়ক/নাবী ধ্বসা রোগ হওয়ার পর প্রতিকারের উপায়ঃ
➡️আক্রান্ত জমিতে রোগ নিয়ন্ত্রণ না হওয়া পর্যন্ত সেচ প্রদান বন্ধ রাখতে হবে।কোনভাবেই উঠতি সেচ দেওয়া যাবেনা।
➡️নিজের বা পার্শ্ববর্তী ক্ষেতে রোগ দেখা মাত্রই ৭ দিন অন্তর নিম্নের যে কোন একটি গ্রুপের অনুমোদিত ছত্রাকনাশক পর্যায়ক্রমিকভাবে নিম্নবর্ণিত হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে গাছ ভালভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। যেমন-
⚠️(ম্যানকোজেব৫০%+ফেনাডিন ১০%)সিকিউর ৬০০ডব্লিউজি-২গ্রাম অথবা
⚠️( প্রোপিনেব ৭০ % + ইপ্রোভেলিকার্ব)মেলোডি ডুও ৬৬.৮ ডব্লিউপি- ২ গ্রাম অথবা
⚠️(ম্যানকোজেব ৬০%+ডাইমেথোমর্ফ৯%)এক্রোবেট এম জেড-২গ্রাম অথবা
⚠️(এমটোকট্রাডিন ৩০%+ডাইমেথোমর্ফ ২২.৫%)-জ্যামপ্রো ডি এম-২গ্রাম অথবা
⚠️(ম্যানকোজেব ৬৪%+সাইমেক্রনিল৮%)- কার্জেট -২ মিলি অথবা
⚠️ (ফ্লুমর্ফ ১০% + ম্যানকোজেব ৫০%)ফুলিমেইন ৬০ ডব্লিউপি -২ গ্রাম।
![]() |
| আলুর মড়ক/নাবী ধ্বসা( Late blight) |
➡️ যদি কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া দীর্ঘ সময় বিরাজ করে ও রোগের মাত্রা ব্যাপক হয় সেক্ষেত্রে নিম্নোক্ত ছত্রাকনাশকের যে কোন একটি মিশ্রণ পর্যায়ক্রমিকভাবে নিম্ববর্ণিত হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ দিন অন্তর স্প্রে করে গাছ ভালভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।
⚠️ রিডোমিল গোল্ড+রিভাস ১০ মিলি পানিতে ১০ এমএল দিয়ে আলুর ভেডে ভালোভাবে স্প্রে করুন।
⚠️ এক্রোবেট এম জেড ৪ গ্রাম + সিকিউর ৬০০ ডব্লিউজি ১ গ্রাম অথবা
⚠️ এক্রোবেট এম জেড ৪ গ্রাম + মেলোডি ডুও ৬৬.৮ ডব্লিউপি ১ গ্রাম অথবা
⚠️ফুলিমেইন ৬০ ডব্লিউপি ৪ গ্রাম + অটোস্টিন ৫০ ডব্লিউডিজি (কার্বেনডাজিম ৫০%) ১ গ্রাম অথবা
⚠️ মেলোডি ডুও ৬৬.৮ ডব্লিউপি ৪ গ্রাম + সিকিউর ৬০০ ডব্লিউজি ১ গ্রাম।
➡️রোগের প্রাদুর্ভাব খুব বেশি হলে ৩-৪ দিন অন্তর ছত্রাকনাশকের মিশ্রণ স্প্রে করতে হবে।
➡️ ছত্রাকনাশক পাতার উপরে ও নিচে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।
➡️ সাধারণ স্প্রেয়ারের পরিবর্তে পাওয়ার স্প্রেয়ার ব্যবহার করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
♥ সতর্কতা:
গাছ ভেজা অবস্থায় জমিতে ছত্রাকনাশক স্প্রে না করাই ভাল। আর যদি স্প্রে করতেই হয় তাহলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে সাবানের গুড়া মিশিয়ে নিতে হবে। ছত্রাকনাশক স্প্রে করার সময় হাত মোজা, সানগ্লাস, মাস্ক ও এপ্রোন ব্যবহার করতে হবে। সবসময় বাতাসের অনুকূলে স্প্রে করতে হবে।

