মরিচ চাষ পদ্ধতি

 

মরিচ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।


মরিচ চাষ



মরিচের চারা


মরিচ একটি গুরুত্বপূর্ন অর্থকরী ফসল। মসলা ফসলের মধ্যে মরিচের আবাদী এলাকা সবার শীর্ষে ও উৎপাদনে এর অবস্থান দ্বিতীয়। কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থায় এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। দৈনন্দিন রান্নায় রং , রুচি ও স্বাদে ভিন্নতা আনার জন্য মরিচ একটি অপরিহার্য উপাদান। মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হলেও মরিচে পুষ্টির প্রায় সব উপাদান উল্লেখযোগ্য পরিমানে বিদ্যমান। পুষ্টিমানে কাঁচা মরিচ ভিটামিন এ ও সি সমৃদ্ধ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে মোট ১.৩০ লক্ষ মে.টন মরিচ উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশে দুই ধরনের মরিচ চাষ করা হয়।

। কম ঝাল বা ঝালবিহীনঃ 


ইহা সবুজ সবজি, আচার এবং সালাদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

২। ঝাল মরিচঃ 



ইহা মসলা হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
কেপসাইসিন নামক রাসায়নিক পদার্থের জন্য মরিচ ঝাঁঝালো হয়।
কেপসানথিন নামক একটি রঞ্জক পদার্থের জন্য মরিচ উজ্জ্বল ও লাল বর্ণের হয়।


মরিচের বাংলা ও ইংরেজি নামঃ 



মরিচকে অর্থকরী ফসল বলা হয়। এর বাংলা নাম মরিচ। ইংরেজি নাম Chilli ও 
বৈজ্ঞানিক নাম Capsicun annuum. 

মাটি


পানি নিস্কাশন সুবিধাযুক্ত বেলে দোঁআশ থেকে এঁটেল দোঁআশ জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ উর্বর দোঁআশ মাটি উত্তম। ক্ষারীয় মাটিতে ফলন ভালো হয় না। মাটির পিএইচ ৬.০ থেকে ৭.০ হলে উৎপাদন ভালো হয়।

জলবায়ুঃ


পলিতে চারামরিচ গ্রীষ্মপ্রধান জলবায়ু উপযোগী ফসল। ডিসেম্বর-জানুয়ারীতে নিম্ন তাপের কারণে গাছের বৃদ্ধি কিছুটা ব্যাহত হয় ও অতিরিক্ত ঠান্ডায় মরিচের ঝাঁঝ কমে যায়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে (২০০-৩০০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায়) সঙ্গে গাছের দৈহিক বৃদ্ধি স্বাভাবিক হতে থাকে। তাপমাত্রা ১৫০ সেলসিয়াসের নিচে বা ৩৫০ সেলসিয়াসের বেশী হলে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন সাধারণত কমে যায়। দেশের যে সমস্ত অঞ্চলে ৭৫ সে.মি. থেকে ১০০ সে.মি. বৃষ্টিপাত হয় এবং মাঝে মাঝে রোদ ও বৃষ্টি হয় সে সব অঞ্চলে মরিচ খুব ভালো হয়। ফসলের প্রাথমিক অবস্থায় অল্প বৃষ্টিপাত এবং ফসলের বৃদ্ধির সময় পরিমিত বৃষ্টিপাত হলে মরিচ খুব ভাল জন্মে।



মাটি শোধন:


বীজতলার উপরের ৩-৪ সেন্টিমিটার ধানের খড়ের স্তর তৈরী করে পুড়িয়ে মাটি শোধন করতে হবে।


জমি চাষ ও ভিটি তৈরীঃ


মাটির প্রকারভেদে জমিতে ৪-৬ টি চাষ ও মই দিতে হয়। শেষ চাষের সময় সুপারিশকৃত মাত্রায় গোবর, টিএসপি ও জিপসাম মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। জমিতে ১ মিটার প্রস্থ ও লম্বায় জমির অবস্থান মত ভিটি তৈরি করতে হবে। পানি সেচ ও নিষ্কাশনের সুবিধার্থে ভিটি ২০ সে.মি. উঁচু হবে ও দুই ভিটির মাঝে ৩০ সে.মি. নালা থাকবে।




বীজ উৎপাদনঃ


চারার পরিচর্যামরিচ পর পরাগায়িত ফসল। কিছু কিছু জাতে স্ব-পরাগায়ন হতে পারে। তবে শতকরা ৯০ ভাগ মরিচে পর-পরাগায়ন হয়ে থাকে। এ কারণে বীজ উৎপাদন করতে হলে বীজ ফসল আলাদা করে লাগাতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন এক জাতের মরিচের জমির চারপাশে অন্তত ৪০০ মিটারের মধ্যে অন্য কোন মরিচের জাত না থাকে। তবে অল্প পরিমানে বীজের জন্য ক্ষেতের সুস্থ সবল নির্বাচিত গাছের ফুল স্ব-পরাগায়িত করে সেগুলি থেকে বীজ সংগ্রহ করা যেতে পারে।

পরিপক্ব, পুষ্ট এবং উজ্জ্বল লাল রঙ এর মরিচ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। সাধারণত একটি মরিচে ৭০-৭৫ টি বীজ থাকে এবং ১০০০ টি বীজের ওজন প্রায় ৫ গ্রাম।

বীজ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় কলাকৌশল অনুসরণ করলে হেক্টর প্রতি ৮০-৮৫ কেজি বীজ উৎপাদন করা সম্ভব।



চারা উৎপাদন পদ্ধতিঃ


বীজতলার উপরের মাটিতে বালি ও পঁচা গোবর দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করতে হবে। বীজ বপনের পূর্বে ভিটাভেক্স বা ক্যাপটান (১ গ্রাম/৫০০ গ্রাম বীজ) দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। বীজতলার চারপাশে সেভিন ডাস্ট ছিটিয়ে দিতে হবে। বীজতলা পলিথিন বা চাটাই দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।




বীজ হার ও বপন/রোপন দূরত্বঃ


আমাদের দেশে দুইভাবে জমিতে মরিচ লাগানো হয়।

১. সরাসরি বীজ বপন
২. বীজতলায় চারা তৈরী করে পরে জমিতে রোপন। 

বীজ হারঃ


রবি মৌসুমে সরাসরি বীজ বপন করলে ৪-৫ কেজি/হেঃ বীজের প্রয়োজন হয়।বীজতলায় চারা উৎপাদন করে লাগালে ১.৫-২.৫ কেজি/হেঃ বীজ দরকার।



চারা রোপণঃ


মূল জমিতে ৫০-৪০ সে.মি. দূরত্বে চারা রোপন করতে হবে।


চারার পরিচর্যাঃ


বাঁশের চাটাই বা পলিথিন দিয়ে বীজতলা ঢেকে দিতে হবে।

বীজ লাগানোর পর চারা বের না হওয়া পর্যন্ত নেটের উপর ঝরনা দিয়ে সেচ দেয়া আবশ্যক।

চারা গজালেই ইনসেক্টপ্রুফ নেট দিয়ে চারা ঢেকে দিতে হবে।

চারা রোপন মুহুর্তে পানি সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

বীজতলার আগাছা নিড়ানি দিয়ে উঠিয়ে ফেলতে হবে ।

চারা তোলার আগের দিন বীজতলায় হালকা সেচ দিলে মাটি নরম হয়।

৩০-৩৫ দিন বয়সের খাটো, মোটা কান্ড ও ৪-৫ পাতা বিশিষ্ট চারা লাগানোর জন্য উত্তম।




সারের পরিমান ও প্রয়োগ পদ্ধতিঃ (শেষ চাষের সময়)


শেষ চাষের সময় হেক্টর প্রতি-

১০ টন গোবর/কম্পোষ্ট;

টিএসপি- ৩৩০ কেজি;

এম ও পি- ৬৫ কেজি;

জিপসাম- ১১০ কেজি;

এই হারে সার গাছের গোড়া থেকে ১০-১৫ সে.মি. দূরে ছিটিয়ে ভিটির মাটিতে মিশিয়ে দিতে হয়।



সারের পরিমান ও প্রয়োগ পদ্ধতিঃ (১ম কিস্তি)


চারা রোপনের ২৫ দিন পর (৫৫-৬০ তম দিনে) ১ম কিস্তিতে হেক্টর প্রতি

ইউরিয়া- ৭০ কেজি;

এম ও পি- ৪৫ কেজি;

এই হারে সার গাছের গোড়া থেকে ১০-১৫ সে.মি. দূরে ছিটিয়ে ভিটির মাটিতে মিশিয়ে দিতে হয়।


সারের পরিমান ও প্রয়োগ পদ্ধতিঃ (২য় কিস্তি)


চারা রোপনের  ৫০ দিন পর (৮০-৮৫ তম দিনে) ২য় কিস্তিতে হেক্টর প্রতি

ইউরিয়া- ৭০ কেজি;

এম ও পি- ৪৫ কেজি;

এই হারে সার গাছের গোড়া থেকে ১০-১৫ সে.মি. দূরে ছিটিয়ে ভিটির মাটিতে মিশিয়ে দিতে হয়।



সারের পরিমান ও প্রয়োগ পদ্ধতিঃ (৩য় কিস্তি)


চারা রোপনের ৭০ দিন পর  (১০০-১০৫ তম দিনে) ৩য় কিস্তিতে হেক্টর প্রতি

ইউরিয়া- ৭০ কেজি;

এম ও পি- ৪৫ কেজি;

এই হারে সার গাছের গোড়া থেকে ১০-১৫ সে.মি. দূরে ছিটিয়ে ভিটির মাটিতে মিশিয়ে দিতে হয়।



হরমোন প্রয়োগঃ (১ম ধাপ)


প্ল্যানোফিক্স নামে এক প্রকার হরমোন প্রয়োগে দেখা গেছে মরিচের ফুল কম ঝরে এবং ফলন বাড়ে। ফুল আসলে (৬০-৬৫ তম দিনে) প্রথমবার প্রয়োগ করতে হবে। এক মিলিলিটার প্ল্যানোফিক্স ৪.৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে সমস্ত গাছের উপর ছিটিয়ে দিতে হবে।




হরমোন প্রয়োগঃ (২য় ধাপ)


প্ল্যানোফিক্স নামে এক প্রকার হরমোন প্রয়োগে দেখা গেছে মরিচের ফুল কম ঝরে এবং ফলন বাড়ে। ফুল আসার ২০-২৫ দিন পরে (৮০-৯০ তম দিনে) দ্বিতীয়বার প্রয়োগ করতে হবে। এক মিলিলিটার প্ল্যানোফিক্স ৪.৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে সমস্ত গাছের উপর ছিটিয়ে দিতে হবে।




আন্তঃপরিচর্যাঃ


নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিস্কার ও মাটি ঝুরঝুরা করতে হয়। চারার সুষ্ঠ বৃদ্ধির জন্য শুস্ক মৌসুমে সেচের খুবই প্রয়োজন। সেচের প্রয়োজনীয় মাটির পানি ধারন ক্ষমতা ও আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে।
শুকনা মৌসুমে মরিচে পানি সেচ খুবই উপকারী। শীত ও খরার সময় জমিতে ১৫ দিন পরপর সেচ দিতে জমে। পানির অভাব হলে ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।
সেচের কয়েক দিন পর মাটিতে চটা দেখা যায়। এই চটা ভেঙ্গে দিতে হবে যাতে শিকড় প্রয়োজনীয় আলো ও বাতাস পায়। এতে গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।



ফসল সংগ্রহঃ


মরিচ কাঁচা অথবা পাকা অবস্থায় তোলা হয়। চারা লাগানোর ৩৫- ৪০ দিন পর (৬৫-৭০ তম দিনে) গাছে ফুল ধরতে শুরু করে, ৫৫-৬০ দিনের মধ্যে (৮৫-৯০ তম দিনে) ফল ধরে। ৭৫ থেকে ৯০ দিনের (১০৫-১২০ তম দিনের) মধ্যে ফল পাকতে আরম্ভ করে। প্রথম ও দ্বিতীয় বারের সংগৃহীত ফসল কাচা মরিচ হিসাবে গণ্য করা হয়। পরের মরিচ পাকা (লাল রং) হিসাবে সংগ্রহ করা হয়। সবুজ, চকচকে, মসৃণ ত্বক এবং মাঝারি ঝাঁঝের কাঁচা মরিচের গ্রহনযোগ্যতা বেশী। লম্বা, উজ্জ্বল লাল বর্ণ, চকচকে, পাতলা মসৃণ ত্বক এবং বেশী ঝাঁঝ পাকা মরিচ (যা পরবর্তীতে শুকানো হয়) মসলা হিসাবে অধিক জনপ্রিয়। মরিচের ফুল ফোটা, ফল ধরা, রং ধারণ ইত্যাদি তাপমাত্রা, মাটির উর্বরতা এবং জাতের উপর নির্ভর করে। শুকনা মরিচের জন্য আধা পাকা মরিচ তুললে মরিচের রং ও গুণগতমান নষ্ট হয়ে যায়।



মরিচ উৎপাদন খরচঃ * ১বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে ফসল উৎপাদন খরচ

ক্রমিক নংখরচের খাতপরিমাণ আনুমানিক মূল্য (টাকা) 
বীজ /চারা৫০০০ চারা১৫০০
পানি সেচ৩ বার১৫০০
শ্রমিক৩০জন(প্রতিজন=১৫০ টাকা) ৪৫০০
সারপ্রয়োজন অনুসারে জৈব সার বাড়িতেই তৈরি করা সম্ভব। তাই এর জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন নেই।
 টিএসপি=৪৩ কেজি (১ কেজি=২৫ টাকা)
 ইউরিয়া=২৮ কেজি (১ কেজি=১৩ টাকা)
 এমপি=২৬ কেজি (১ কেজি=২৮ টাকা)
২১৬৭
কীটনাশকপ্রয়োজন অনুসারে জৈব বা রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার***
নিজস্ব/দোকান/জমি ভাড়া   একবছর৪০০০
***মাটির জৈব গুণাগুণ রক্ষা ও উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য জৈব সার ও জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে লাভের পরিমাণ বাড়তে পারে।

মূলধনঃ এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে মরিচ চাষের জন্য প্রায় ১০০০০ টাকার (কম-বেশী) টাকার প্রয়োজন হবে। মূলধন সংগ্রহের জন্য ঋণের প্রয়োজন হলে নিকট আত্মীয়-স্বজন, সরকারী ও বেসরকারী ঋণদানকারী ব্যাংক বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান (এনজিও)-এর সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এসব সরকারি ও বেসরকারি ঋণদানকারী ব্যাংক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) শর্ত সাপেক্ষে ঋণ দিয়ে থাকে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url